Thursday 26 December 2013

-বর্তমান সরকার শিক্ষা সংস্কৃতিসহ সকল পর্যায়ে ইসলামের ওপর নগ্ন আঘাত হেনেছে -ধর্মনিরপেক্ষ নীতির আড়ালে ঈমানী চেতনা মুছে দিতে চাচ্ছে নাস্তিক্যবাদের পক্ষ ত্যাগ করে অবিলম্বে গণমানুষ ও তৌহিদী জনতার ওপর জুলুম-অত্যাচার বন্ধ করুন -হেফাজতে ইসলাম


গতকাল বুধবার হেফাজতের কেন্দ্রীয় কার্যালয় হাটহাজারীতে শীর্ষ নেতৃবৃন্দের বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফ করছেন মহাসচিব আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী
: গত ১২ ও ১৩ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের জমিয়তুল ফালাহ ময়দান এবং ২৪ ডিসেম্বর ঢাকার মতিঝিল শাপলা চত্বরে অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামকে মহাসম্মেলন করতে না দেয়ার সরকারি সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়েছেন সংগঠনটির কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ। গতকাল (বুধবার) বেলা ২টায় হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কার্যালয় দারুল উলুম হাটহাজারী মাদ্রাসায় ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরসহ কেন্দ্রীয় কমিটির নেতৃবৃন্দের এক জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। হেফাজত আমীর দেশের শীর্ষ আলেম শাইখুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন সিনিয়র নায়েবে আমীর আল্লামা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী, নায়েবে আমীর আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী, মহাসচিব আল্লামা হাফেজ মুহাম্মদ জুনায়েদ বাবুনগরী, আল্লামা তাজুল ইসলাম, আল্লামা আব্দুল হামিদ পীর সাহেব মধুপুর, মাওলানা জুনায়েদ আল-হাবীব, মাওলানা আব্দুর রব ইউসুফী, মাওলানা সলিম উল্লাহ, মাওলানা লোকমান হাকিম, মাওলানা মুহাম্মদ শফি, মাওলানা ফজলুল করীম কাসেমী, মাওলানা আাব্দুল করিম, মাওলানা নাজমুল হাসান, মাওলানা শফিকুদ্দীন, মাওলানা বাহাউদ্দীন জাকারিয়া, মাওলানা আনাস মাদানী, মাওলানা আশরাফ আলী নিজামপুরী, মাওলানা মুনির আহমদ, মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী, মাওলানা সাখাওয়াত হোসাইন, মাওলানা মীর মুহাম্মদ ইদরিস, মুফতি ফখরুল ইসলাম, মাওলানা হাসান মুরাদাবাদী প্রমুখ।
বৈঠকে হেফাজতে ইসলামের সাংগঠনিক বিভিন্ন বিষয় ছাড়াও দেশের বিদ্যমান অস্থিতিশীল ও সংকটময় পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য ওলামায়ে কেরামের করণীয় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা হয়। বৈঠকে হেফাজত নেতৃবৃন্দ ঈমান-আক্বিদাভিত্তিক অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামকে বিগত ১২ ও ১৩ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের জমিয়তুল ফালাহ ময়দান এবং ২৪ ডিসেম্বর ঢাকার মতিঝিল শাপলা চত্বরে ধর্মীয় মহাসমাবেশ করতে না দেয়ায় সরকারের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, বর্তমান মহাজোট সরকার সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক ও ফ্যাসিবাদী কায়দায় বাকস্বাধীনতাসহ জনগণের মৌলিক অধিকারকে হরণ করছে। জোর-জুলুম ও অন্যায়ভাবে ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখার চেষ্টাসহ নাগরিকদেরকে এসবের প্রতিবাদ পর্যন্ত করতে দিচ্ছে না। দেশের সর্বত্রই আজ ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হয়েছে। একদিকে সরকার ইসলামবিদ্বেষী নাস্তিক্যবাদীদেরকে সার্বিক সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে ওলামা-মাশায়েখদেরকে ওয়াজ-মাহফিল, তাফসীর মাহফিল ও ইসলামী সম্মেলন করতে দিচ্ছে না। একটি বৃহৎ মুসলিম অধ্যুষিত দেশের নাগরিকগণ পবিত্র কুরআন-হাদীস ও ইসলামের বাণী প্রচার করতে সরকারিভাবে বাধাগ্রস্ত হবেন, এটা কল্পনাও করা যায় না।
বৈঠকে হেফাজত নেতৃবৃন্দ আরো বলেন, আজ ইসলামবিদ্বেষী নাস্তিক্যবাদী কথিত গণজাগরণ মঞ্চের রাস্তা দখল ও সমাবেশ করতে অনুমতির প্রয়োজন হয় না, অথচ ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশ হওয়া সত্ত্বেও তৌহিদী জনতাকে ওয়াজ-মাহফিল ও ইসলামী সম্মেলন করতে অনুমতি দেওয়া হয় না। মূলত ধর্মনিরপেক্ষ নীতির আড়ালে বর্তমান সরকার এই দেশ থেকে ইসলাম ও ঈমানী চেতনাকে মুছে দিতে চাচ্ছে।
তারা আরো বলেন, বর্তমান সরকার নাস্তিক্যবাদী ও ইসলামবিদ্বেষীদের প্ররোচনায় সংবিধান থেকে মহান আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাসের নীতিকে বাদ দিয়ে দেশে ধর্মনিরপেক্ষতা তথা নাস্তিকতা চালু করছে। শিক্ষা, সংস্কৃতিসহ সকল পর্যায়ে ইসলামের ওপর নগ্ন আঘাত হেনেছে। দাড়ি, টুপি, নামাযী ও হিজাবধারী মা-বোনদেরকে রাষ্ট্রীয়ভাবে বিভিন্ন পর্যায়ে হয়রানি করা হচ্ছে। সরকারের ইসলামবিরোধী ধর্মনিরপেক্ষ নীতির কারণে দেশের সকল স্তরে নাস্তিক্যবাদীরা ইসলামবিরোধী নীতি ও প্রথা চালু করার প্রয়াস চালাচ্ছে। এ সরকার হিন্দু, বৌদ্ধসহ ভিন্নধর্মাবলম্বীদের সকল ধর্মীয় অনুষ্ঠানে পুলিশ-র‌্যাব দিয়ে নিñিদ্র নিরাপত্তা দিয়ে আসলেও মুসলমানদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে নিরাপত্তা দূরে থাকুক, বরং নিষেধাজ্ঞা জারি করে ইসলামবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেছে। এদেশের কোটি কোটি মুসলমান এটা কোনভাবেই মেনে নিতে পারে না।
বৈঠকে শীর্ষ ইসলামী নেতৃবৃন্দ আরো বলেন, ইসলাম ধর্মীয় কর্মসূচিতে বাধা দিয়ে এই সরকার এটাই প্রমাণ করতে চাচ্ছে যে, তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনসাধারণের পক্ষে নয়, বরং তারা এদেশের মুসলমানদের ঈমান-আক্বিদাকে ধ্বংস করে নাস্তিক্যবাদ প্রতিষ্ঠার জন্যই কাজ করে যাচ্ছে। যেখানে ওয়াজ-মাহফিল ও ইসলামী সম্মেলন করতে বাধা দিচ্ছে, তাতে এই সরকার যে ইসলামবিরোধী, ঈমান-আক্বিদা বিরোধী, আল্লাহ-রাসূলবিরোধী; এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। সরকারের অন্যান্য ইসলামবিরোধী পদক্ষেপের পাশাপাশি ওয়াজ-মাহফিল, তাফসীরুল কুরআন মাহফিল ও ইসলামী মহাসম্মেলন বন্ধ ও নিষিদ্ধ করার বর্তমান ভূমিকায় আমরা জোর আশঙ্কা করছি, এই সরকার ক্ষমতায় থাকলে ভবিষ্যতে দেশের মসজিদে আযান দেয়া নিষিদ্ধ করবে, মক্তব মাদরাসা বন্ধ করে দেবে এবং দাড়ি-টুপি ও হিজাব পরে কাউকে রাস্তায় বের হতে দেবে না।
বৈঠকে হেফাজত নেতৃবৃন্দ আরো বলেন, বর্তমান সরকার ঈমান-আক্বিদাবিরোধী বিভিন্ন কার্যকলাপের সাথে যেমন প্রকাশ্য জড়িয়ে পড়েছে, তেমনি গণতান্ত্রিক ও নাগরিক অধিকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে চরম হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। এ সরকারের হাতে মুসলমানদের ঈমান-আক্বিদা নিয়ে বেঁচে থাকা যেমন নিরাপদ নয়, তেমনি জনগণের জানমালও নিরাপদ নয়। জনসমর্থনহীন সরকার অন্যায়ভাবে ক্ষমতাকে আঁকড়ে রাখার জন্য প্রতিদিন অসংখ্য প্রতিবাদী ও নিরীহ জনতাকে গুলী করে হত্যা করতেও দ্বিধা করছে না। হামলা, মামলা ও গুমের পথ বেছে নিয়েছে তারা। সরকার প্রতিবাদী জনতা ও নেতৃবৃন্দকে হামলা-মামলা খুন-গুম ও বুলডোজার দিয়ে বাড়ি-ঘর গুঁড়িয়ে দিয়ে হিং¯্র উপায়ে নাগরিক অধিকার হরণ করার মতো বর্বরতা শুরু করছে। সরকারের একগুঁয়েমি নীতির কারণে ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক সহিংসতায় চাল-ডাল, নিত্য ব্যবহার্য খাদ্য ও আসবাবপত্রসহ দ্রব্য মূল্য এখন ধরাছোঁয়ার বাইরে। অথচ সরকারের রাতদিন ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখার আয়োজন ছাড়া গণমানুষের এই শোচনীয় অবস্থার নিরসনে সামান্যতম চিন্তাও নেই। ওপরন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অন্যায় নির্দেশ দিয়ে হামলা-মামলা, গ্রেফতার, গুলীবর্ষণ, গুমসহ এক ত্রাসের রাজত্ব তৈরি করে গণমানুষকে জুলুমের শেষ প্রান্তে নিয়ে গেছে। এমন জোর-জুলুম ও নৈরাজ্যকর অবস্থা একটা সভ্য ও গণতান্ত্রিক দেশে চলতে পারে না। আল্লাহ-রাসূল ও ইসলামের ওপর কেউ আঘাত হানলে যেমন প্রতিবাদ করা ঈমানী দায়িত্ব, তেমনি মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ করতে চাইলে সেখানেও প্রতিবাদ করতে ইসলামের নির্দেশনা রয়েছে।
বৈঠকে হেফাজত নেতৃবৃন্দ সরকারের প্রতি জোর দাবি জানিয়ে বলেন, নাস্তিক্যবাদের পক্ষ ত্যাগ করে অবিলম্বে গণমানুষ ও তৌহিদী জনতার ওপর জুলুম-অত্যাচার বন্ধ করুন। নাগরিকদের মৌলিক অধিকার হরণসহ হামলা, মামলা ও মানুষ হত্যা বন্ধ করুন। দেশের বর্তমান অস্থিতিশীল ও নৈরাজ্যকর পরিবেশ স্বাভাবিক করে অবিলম্বে সকল দলের অংশগ্রহণে নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা নিয়ে দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করুন। দেশ ও জনগণের জন্য ওলামায়ে কেরামেরও দায়-দায়িত্ব রয়েছে, তারা চুপ করে বসে থাকবে না। দ্রুত বিদ্যমান পরিস্থিতির সমাধান না হলে ওলামায়ে কেরাম দেশব্যাপী সম্মিলিতভাবে তৌহিদী জনতাকে সাথে নিয়ে ‘দেশ ও ঈমান রক্ষার মঞ্চ’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সরকারকে অত্যাচার ও ফ্যাসিস্ট কায়দায় দেশ পরিচালনা থেকে বিরত রাখতে বাধ্য করবে।
 বৈঠক শেষে হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। তিনি বলেন, ঢাকার শাপলা চত্বরে মহাসমাবেশ করতে না দিয়ে সরকার আমাদের সাথে অগণতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদী আচরণ করেছে। এটি আমাদের কোন রাজনৈতিক বা নির্বাচনী সমাবেশ ছিল না। এটা দ্বীনি সমাবেশ। এই সমাবেশ করতে না দিয়ে সরকার গণতন্ত্রকে হরণ করেছে। আমরা এই মহাসমাবেশ করতে বাধা প্রদান করায় সরকারের এই অগণতান্ত্রিক আচরণের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। দেশের অশান্ত, সহিংস পরিবেশ পরিস্থিতি নিরসনের জন্য ও শান্তি-শৃংখলা ফিরিয়ে আনাসহ দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষার করার জন্য আগামী ২৭ ডিসেম্বর শুক্রবার সারা দেশে দোয়া দিবস পালনের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা হবে। এছাড়া আগামীতে সারা দেশে জেলা ও উপজেলায় শানে রেসালাত সম্মেলন করা হবে। বৈঠক শেষে বিকেল ৪টায় হেফাজত আমীর আল্লামা শাহ আহমদ শফীর পরিচালনায় শীর্ষ ওলামায়ে কেরাম জাতির বর্তমান ক্রান্তিকালীন পরিস্থিতি থেকে মুক্তি, নাগরিকদের জানমালের সুরক্ষা এবং দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের হেফাজতের জন্য মহান আল্লাহর সাহায্য কামনা করে বিশেষ মুনাজাত করা হয়।

No comments:

Post a Comment