দেশবরেণ্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী এবং রাজনীতিকরা বলেছেন, নির্বাচনকালীন সময়ের জন্য প্রধানমন্ত্রীর সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য নয়। দেশের জনগণ নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চায়। বর্তমান সরকার একে সংবিধান থেকে বাদ দিয়ে জটিলতা সৃষ্টি করেছে। তাই সরকারকেই একে সংবিধানে পুনঃস্থাপন করে জটিলতা নিরসন করতে হবে। তারা বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে বিদ্যমান রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানের কোনো প্রস্তাবনা নেই। প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকার গঠনের কথা বললেও এ সরকারের প্রধান কে হবেন—সে ব্যাপারে তিনি কিছুই বলেননি। প্রধানমন্ত্রী যদি সর্বদলীয় সরকারের প্রধান হন, তাহলে প্রধান বিরোধী দল তা মেনে নেবে না। ফলে বিদ্যমান রাজনৈতিক সঙ্কটের কোনো সমাধান হলো না; সঙ্কট রয়েই গেল। গতকাল জাতির উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের পর তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় দৈনিক আমার দেশকে তারা এসব কথা বলেন।
এ ব্যাপারে প্রখ্যাত আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলেন, প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রস্তাব দিয়েছেন। এ সরকারের প্রধান কে হবেন, নাকি তিনি নিজেই থাকবেন—সে বিষয়ে কোনো বক্তব্য দেননি। আবার তিনি এও বলেছেন যে, বর্তমান সংবিধান অনুযায়ীই তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রাষ্ট্রপতিকে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে লিখিত প্রস্তাব দেবেন। সবকিছু নিয়ে এখনও ধোঁয়াশা রয়েছে। তারপরও আমি বলব, প্রধানমন্ত্রী সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাব দিয়েছেন। এটি ইতিবাচক। প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতার প্রমাণ আমরা তখনই পাব, যখন দেখব দুই জোট থেকে পাঁচজন করে দশজন মন্ত্রী নির্ধারণ করা হবে। এরাই তৃতীয় একজন ব্যক্তিকে সরকারের প্রধান হিসেবে মনোনীত করার সুযোগ পাবেন। তারপরও আমি মনে করি, প্রধানমন্ত্রীর এ প্রস্তাব গ্রহণ করে বিএনপি পরবর্তী প্রস্তাব পেশ করবে। এভাবে একটি সমঝোতার পথ বেরিয়ে আসবে বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান বলেন, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে সমঝোতার উপাদান রয়েছে। বিরোধী দলের উচিত হবে প্রধানমন্ত্রীর সমঝোতার প্রস্তাব ধরেই সমাধানের পথে এগোনো। বিদ্যমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সমঝোতার পথেই এগিয়ে যাওয়া উচিত। আকবর আলি খান বলেন, প্রাক-নির্বাচন রাজনৈতিক ভাষণ এটি। এতে গঠনমূলক উপাদান রয়েছে। এখন তা ধরেই এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা উচিত। বিরোধী দল কী চায়—তা কখনও স্পষ্ট করেনি। এখন সংসদে আলোচনায় বসা উচিত। কোথায়, কীভাবে তাদের সঙ্গে একমত হওয়া যায়, তা আলোচনা হতে পারে।
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. তালুকদার মনিরুজ্জামান বলেন, প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকার গঠনের কথা বললেও এ সরকারের প্রধান কে হবেন—এ ব্যাপারে তিনি কিছুই বলেননি। প্রধানমন্ত্রী যদি সর্বদলীয় সরকারের প্রধান হন, তাহলে প্রধান বিরোধী দল তা মেনে নেবে না। ফলে বিদ্যমান রাজনৈতিক সঙ্কটের কোনো সমাধান হলো না; সঙ্কট রয়েই গেল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. মনিরুজ্জামান মিঞা বলেন, প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে নির্বাচনকালীন জাতীয় সরকার গঠনের কথা বললেও সুনির্দিষ্ট কোনো রূপরেখা ঘোষণা করেননি। অতএব, প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যের মধ্যে কোনো সততা বা আন্তরিকতা আছে বলে মনে করি না। এটা একটি রাজনৈতিক প্রহসন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ একেবারেই গতানুগতিক। আমাদের আকাঙ্ক্ষা ছিল তিনি এদেশের মানুষের প্রত্যাশা অনুযায়ী সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্দলীয় সরকারের অধীনে একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথ সুগম করবেন। কিন্তু তিনি তার বক্তব্যে এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট কিছুই বলেননি। প্রধানমন্ত্রী সর্বদলীয় সরকারের কথা বললেও এর কোনো রূপরেখা উল্লেখ করেননি।
বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান ও সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্য দেশকে অতি দ্রুত সংঘাতের দিকে নিয়ে যাবে। তিনি অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় মানুষের মনে একটি ধূম্রজাল সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেছেন, সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতিকে নির্বাচনের জন্য লিখিত পরামর্শ দেবেন। আবার সংবিধান অনুযায়ী তিনিই রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী থাকবেন। শেখ হাসিনাকে নির্বাহী বিভাগের প্রধান বা প্রধানমন্ত্রী রেখে নির্বাচনকালীন যে সরকারই হোক, তা সুষ্ঠুভাবে কাজ করতে পারবে না।
তিনি বলেন, বিরোধী দলের মূল দাবিই হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগ করে নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর পুরো বক্তব্যে এ নিয়ে কোনো ইঙ্গিত নেই। মূলত প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যের মাধ্যমে ধূম্রজালের সৃষ্টি করেছেন।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সর্বদলীয় মন্ত্রিসভা গঠনের প্রস্তাবে বিস্তারিত কিছু নেই। বিরোধী দল থেকে কতজন মন্ত্রী নেয়া হবে বা কোন দফতরে দেয়া হবে—এগুলো বিস্তারিত বললে ভালো হতো। তিনি বলেন, দেশের চলমান সঙ্কট সমাধানের চেয়ে প্রধানমন্ত্রী তার সরকারের সাফল্যের কথাই বলেছেন।
ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও মহাজোটের এমপি রাশেদ খান মেনন বলেন, আমাদের দল বরাবরই দাবি করে আসছে যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ছাড়া প্রভাবমুক্ত ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান করা সম্ভব নয়। প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাব দিয়েছেন। এটি অবশ্যই ইতিবাচক। নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে যে শঙ্কা ও সন্দেহ ছিল, প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবের পর সেটা কেটে গেছে।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) সভাপতি আ.স.ম. আবদুর রব বলেন, নির্বাচনকালীন সময়ের জন্য প্রধানমন্ত্রীর সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য নয়। দেশের জনগণ নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চায়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার অতীতে অসাংবিধানিক ছিল না। বর্তমান সরকার একে সংবিধান থেকে বাদ দিয়ে জটিলতা সৃষ্টি করেছে। তাই সরকারকেই একে সংবিধানে পুনঃস্থাপন করে জটিলতা নিরসন করতে হবে।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি এবং সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক পিয়াস করিম বলেন, বেশ কিছুদিন ধরেই বিভিন্ন রাজনৈতিক মহলে নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকারের কথা শোনা যাচ্ছিল। প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে ভাষণেও এই সর্বদলীয় সরকারের কথা বলেছেন। কিন্তু এই সরকারের প্রধান কে হবেন, সংসদ বহাল থাকবে কিনা, মন্ত্রিসভা থাকবে কিনা—এসব ব্যাপারে তিনি কিছুই বলেননি। ফলে প্রধানমন্ত্রীর এ প্রস্তাবে আশান্বিত হওয়ার কিছু নেই।
No comments:
Post a Comment