Sunday, 8 December 2013

আইন বিশেষজ্ঞদের অভিমত মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে রিভিউ মোল্লার সাংবিধানিক অধিকার-গালীব ইহসান





মৃত্যুদণ্ডের রায় পুনর্বিবেচনা বা রিভিউ করার আবেদনকে সাংবিধানিক অধিকার হিসেবে আখ্যায়িত করে এই অধিকার থেকে জামায়াত নেতা কাদের মোল্লাকে বঞ্চিত না করার পক্ষে মত দিয়েছেন আইন বিশেষজ্ঞরা। তবে, মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন অনুযায়ী কাদের মোল্লা এই অধিকার পাবেন না বলে মনে করেন সরকার পক্ষের আইনজীবীরা।

এমনই পটভূমিতে কী অপেক্ষা করছে আবদুল কাদের মোল্লার ভাগ্যে- তা নিয়ে চলছে নানামূখী গুঞ্জন। কেউ বলছেন এবার আর মোল্লার রক্ষা নাই। আবার কেউ বলছেন বিষয়টির নিস্পত্তি হতে আরো কিছুটা সময় লাগবে।

সূত্র অনুযায়ী, আইনী জটিলতার কারণে আবদুল কাদের মোল্লার রায় এখনই কার্যকর করা সম্ভব নয়। রায় কার্যকরে আইনী বাধা কী? তা এখন আইনবিদ থেকে শুরু করে কুলি মজুর সবারই প্রশ্ন।

আইন অনুযায়ী একটি মামলার সব ধরণের কার্যক্রম শেষ হলে জেল কোড(কারা বিধি) মোতাবেক ২১ থেকে ২৮ দিনের মধ্যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে হবে। তার আগে রায় কার্যকর করা যাবে না।

এদিকে, ট্রাইব্যুনালের আইনটি একটি বিশেষ আইন। এই আইনের মাধ্যমে বলে দেয়া হয়েছে হাইকোর্ট কোন আদালতের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখলে আপিলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি আপিল এবং লিভ টু আপিল করতে পারলেও ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে সরাসরি আপিলে মাত্র একটি আপিল করা যাবে।

আব্দুল কাদের মোল্লার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তবে, আপিলের পর রিভিউ করা যাবে না-এমন কোন বিধান ট্রাইব্যুনালের আইনের কোথাও উল্লেখ নাই।

সংবিধানের আইন এবং সুপ্রিমকোর্টের বিধি অনুযায়ী রিভিউর অধিকার আব্দুল কাদের মোল্লার মানবাধিকার ও সাংবিধানিক অধিকার। তাছাড়া রিভিউ করতে পারবেন না প্রশ্নে সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা নিয়ে ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে জোড়ালো সমালোচনা। তাছাড়া, রায়ে সুপ্রিমকোর্টও এমন কোন পর্যবক্ষণ দেয়নি যে মোল্লার ক্ষেত্রে এই বিধান গ্রহণযোগ্য নয়।

গত ১৭ সেপ্টেম্বর আপিলে রায় প্রকাশের পর রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ও আসামীপক্ষের আইনজীবীদের ভিন্নমতের কারণে এ বিষয়ে সংবিধান বিশেষজ্ঞ, ফৌজধারী আইন বিশেষজ্ঞ এবং অপরাধ আইন বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা বলে জানা যায় যে, কাদের মোল্লাকে রিভিউর সুযোগ না দিলে সংবিধান ও সুপ্রিমকোর্টের বিধানের অবমাননা করা হবে। এছাড়া রিভিউ ছাড়া রায় কার্যকর করা হলে মানবাধিকারের লঙ্ঘন হবে বলেও মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

জানতে চাইলে আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেন, তিনি আশা করছেন, দ্রুততম সময়ে রায় কার্যকর হবে। পূর্ণাঙ্গ রায় এখন ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল কারা কর্তৃপক্ষ ও জেলা প্রশাসকের কাছে রায় কার্যকরের আদেশ ইতোমধ্যে পাঠিয়ে দিয়েছে। তারাই এখন রায় কার্যকরের জন্য যথাযথ সময়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন।

আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩-এ মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকরের কোনো নির্ধারিত সময়সীমা নেই উল্লেখ করে আইন প্রতিমন্ত্রী বলেন, অন্যান্য ফৌজদারি অপরাধে মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকরের নির্ধারিত সময়সীমা এ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। এ ছাড়া এই আইনে রায় পুনর্বিবেচনার কোনো সুযোগ নেই।

ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিদের প্রধান সমন্বয়কারী অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান বলেন, ট্রাইব্যুনালস আইনের ২০(৩) উপধারা অনুসারে সাজা সরকারের আদেশ দ্বারা কার্যকর হবে। এ আইনে ফৌজদারি কার্যবিধি ও অন্যান্য বিধান প্রযোজ্য হবে না। পুনর্বিবেচনার আবেদন করা হলে সর্বোচ্চ আদালত সিদ্ধান্ত দিতে পারেন।

রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি অ্যাভোকেট গোলাম আরিফ টিপু বলেন, কাদের মোল্লা যে অপরাধ করেছেন তার ক্ষেত্রে কোন রিভিউ প্রযোজ্য নয়। তার অপরাধ মানবতাবিরোধী নাহলে এই বিধান তার ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য ছিলো।

মানবতাবিরোধী অপরাদের মামলায় আসামিপক্ষের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আমরা অনুলিপি পাওয়ার জন্য আবেদন করেছি। রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি পাওয়ার পর সংবিধানের ১০৫ অনুচ্ছেদ ও সুপ্রিম কোর্টের বিধি অনুসারে পুনর্বিবেচনার আবেদন করবো। পুনর্বিবেচনার অধিকার আছে কি না, একমাত্র আপিল বিভাগই তা নির্ধারণ করতে পারেন। আন্য কেউ কিছু বললেই তা আইন হিসাবে দেখা ঠিক হবে না।

তিনি বলেন, কারাবিধি (জেল কোড) অনুসরণ না করে কারা কর্তৃপক্ষ রায় কার্যকর করতে পারেন না। আমরা আশা করছি রিভিউ নিষ্পত্তির আগে কারা কর্তৃপক্ষও রায় কার্যকরের পদক্ষেপ থেকে দূরে থাকবেন।

যদি রায় কার্যকর করা হয় তাহলে কি হবে? এমন প্রশ্নের জবাবে রাজ্জাক বলেন, তাহলে আইনের লঙ্ঘন হবে। আর বুঝতে হবে সম্পূর্ণ বিচার প্রক্রিয়া ছিলো একজন মোল্লাকে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করার জন্য। তিনি বলেন, রিভিউ ছাড়া রায় কার্যকর করা রাজনৈতিক হত্যার শামিল।

মোল্লার রিভিউর অধিকার আছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ আনিসুল হক বলেন, সংবিধানের ১০৫ অনুচ্ছেদের অধিকার কাদের মোল্লার আছে। এ অধিকার যদি দেওয়া হয়, তাহলে এ রায়ের স্বচ্ছতা নিয়ে কোনো দিন প্রশ্ন উঠবে না।

তিনি বলেন, এখন রায়ের অনুলিপি কারা কর্তৃপক্ষ ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে যাবে। যখন তারা জানবে, কাদের মোল্লার আপিল খারিজ হয়ে গেছে, সেই মুহূর্ত থেকে ফাঁসি দেওয়ার আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়াগুলো শুরু করবে। প্রক্রিয়া শুরুর ২১ দিনের পরে ও ২৮ দিনের আগে ফাঁসি কার্যকর করার নিয়ম। তবে এর মধ্যে যদি সংক্ষুব্ধ পক্ষ আবেদন করেন, তখন তা সর্বোচ্চ আদালতের ওপর নির্ভর করবে। যদি স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়, তখন ফাঁসি দেওয়া যাবে না। স্থগিতাদেশ উঠে গেলে আবার ফাঁসির কার্যক্রম শুরু করা যাবে।

সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদিন মালিক বলেন, সংবিধান অনুযায়ী কাদের মোল্লার রিভিউ করার অধিকার আছে। এখন সুপ্রিমকোর্টই এ ব্যপারে সিদ্ধান্ত দেবেন। রিভিউর অধিকার দেয়া হলে বিচার নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারবেন না।

তবে, আরেক সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার এম আমীরুল ইসলাম বলেন, কাদের মোল্লার অপরাধের ধরণ অনুযায়ী তিনি রিভিউর অধিকার হারিয়েছেন। স্বাভাবিক হত্যা, ধর্ষণের ক্ষেত্রে হলে তাকে এই অধিকার দেয়া যেত।

বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস প্রেসিডেন্ট খন্দকার মাহবুব আলম বলেন, একজন মৃতুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যাক্তি আপিলে দুটি আপিল করতে পারেন। এক্ষেত্রে কাদের মোল্লাকে একটি আপিলের সুযোগ দেয়া হয়েছে। এরপর তার সাংবিধানিক অধিকার রিভিউ নিয়েও যে তালবাহানা শুরু হয়েছে তা সম্পূর্ণরুপে অসাংবিধানিক।

তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, ধরেন মোল্লাকে ফাঁসি দিয়ে দেয়া হলো। এরপর যদি কখনো প্রমাণিত হয় তিনি নির্দোষ তখন কি আপনারা তার এই জীবন ফিরিয়ে দিতে পারবেন? আপনারা আইনের লোক আইন মোতাবেক কথা বলুন। কারো জীবন নিয়ে রাজনীতি করবেন না।

মাহবুব বলেন, রায়ে সুপ্রিমকোর্টও বলেননি যে মোল্লা রিভিউ করতে পারবেন না। সুতরাং রিভিউ করা যাবে। আর রিভিউর আগে রায় কার্যকর করলে আইনের লঙ্ঘন হবে।

তিনি বলেন, বিচার বিভাগেও যে কী পরিমান রাজনীতি করেছে আওয়ামী লীগ, তার বাস্তব প্রমান হলো ট্রাইব্যুনালের বিচারকে প্রভাবিত করার চেষ্টা।

সরকারের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট মাহবুবে আলম অবশ্য বলছেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনে আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন করার সুযোগ নেই।

এদিকে, রাষ্ট্রপক্ষেরই এক কৌঁসুলি ড. তুরিন অফরোজ বলেন, ট্রাইব্যুনাল আইন অনুযায়ী কোন মামলা বিচারাধীন থাকলে আসামী রিভিউ করতে পারবেন না। কিন্তু আব্দুল কাদের মোল্লার মামলাটি এখন আর ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন নয়। সুতরাং কাদের মোল্লা সাংবিধানিকভাবে এ আদেশের বিরুদ্ধে রিভিউ করতে পারবেন।

তিনি বলেন, ট্রাইব্যুনালের আইন অনুযায়ী রিভিউ করার কোন সুযোগ যেমন নেই, অপরদিকে আপিল বিভাগে যে রিভিউ করা যাবে না তাও এই আইনে স্পষ্টভাবে বলা হয়নি। সুতরাং সংবিধান অনুযায়ী আব্দুল কাদের মোল্লা এই রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ করতে পারবেন।

এখন প্রশ্ন হলো আসলে আব্দুল কাদের মোল্লার ভাগ্যে কি ঘটবে তা কেউ বলতে পারছেন না। ইতোমধ্যেই মোল্লার বিরুদ্ধে মৃত্যুপরোয়ানা জারি করেছেন ট্রাইব্যুনাল। অপরদিকে, রিভিউর আবেদনের পরামর্শের জন্য তার আইনজীবীরা কারা কর্তৃপক্ষের নিকট আবেদন করেছেন। এর সমাধান দিতে পারেন এখন শুধু আপিল বিভাগ। তাই আপিল বিভাগের সিদ্ধান্তের দিকে দৃষ্টি সবার।

http://www.timenewsbd.com/law---court/2013/12/08/18782#sthash.vksC0mZo.dpuf

No comments:

Post a Comment