Saturday 21 December 2013

যে স্বাধীনতা বন্ধুত্বে বিকোয় “মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়নি। আবার তোরা যুদ্ধে চল”



বুদ্ধি বেচে জীবিকা নির্বাহ করা নানা কিসিমের বুদ্ধিপরজীবীর কোন কলামে কিংবা ‘ফেবু দেশপ্রেমী’দের স্ট্যাটাসে এই ধরণের কিছু কথা প্রায়ই চোখে পড়ে। বিষয়টা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এদের সাথে আমার এই একটা ক্ষেত্রে একটা শেয়ারড ভ্যালু কাজ করে। কারণ আমিও বিশ্বাস করি মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়নি। তবে আমার কথা তাদের মত আট আনা দামের সস্তা আবগের আগ্নেয়গিরি থেকে উদগীরিত নয়। বাস্তবিক। কিন্তু তা বুঝতে আমাদের একটু পেছনে ফিরে যেতে হবে। চলুন ফিরে যাই ১২ বছর আগে। ২০০১ সালের এপ্রিল মাসে। 

সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার প্রতাপপুর সীমান্তে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তরেখার ২শ' ৫০ গজ ভিতরে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ভারতীয় ও মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প ছিল। দেশ স্বাধীনের পর অরণ্যবেষ্টিত পাহাড়ী এলাকা পাদুয়ার সেই ক্যাম্পসহ ২৩০ একর ভূমি ভারতীয় সীমান্তরক্ষীবাহিনী বিএসএফ অপদখল করে নেয়। এই ক্যাম্পের আশপাশে বাংলাদেশের জনগণের বসবাস রয়েছে। ১৯৭২ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত বিএসএফ সদস্যরা এই ক্যাম্প দখলে রাখে। ১৯৭৪ ও ১৯৭৫ এ দুইবার এই জায়গাটি স্বাধীন করতে তৎকালীন বিডিআর অভিযান চালালেও অজানা কারণে তা সফল হয়নি।

১৯৯৯ সালের মাঝামাঝি সিলেট সীমান্তের লাতু এলাকা থেকে কয়েকজন বিডিআর সদস্যকে বিএসএফ ধরে নিয়ে যায়। এ সময় বিডিআরের মহাপরিচালক ছিলেন মেজর আজিজুর রহমান। বিডিআর এ সময় পাদুয়া দখলে নিতে বিএসএফকে হুশিয়ারি জানিয়েছিল। এই ঘটনাটি ছাড়া পাদুয়ায় বিএসএফের ফাঁড়ি নিয়ে আর কখনও উচ্চবাচ্য হয়নি। এরই প্রেক্ষিতে বিডিআর ১৫ এপ্রিল ২০০১ সলে প্রায় ২০০ ফোর্স নিয়ে একটা গুলিও খরচ না করে পাদুয়া গ্রাম পুনরুদ্ধার করে এবং সেখানে ৩টি ক্যাম্প স্থাপন করে তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করে। প্রায় ৭০ জন বিএসএফ এ সময় আত্মসমর্পণ করে। কিন্তু তৎকালীন আওয়ামী সরকারের নির্দেশে দুই দিন পরেই আবার ভারতের হাতে ছেড়ে দেয়া হয় পাদুয়া।

১৮ এপ্রিল ২০০১। পাদুয়ার ঘটনার প্রতিশোধ নিতে বিএসএফ সীমান্তের- ১০৬৭/৩ পিলার অতিক্রম করে প্রবেশ করে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে। কুড়িগ্রামের রৌমারি উপজেলার বড়াইবাড়ি বিডিআর ফাঁড়িতে ভোর চারটার দিকে অতর্কিত হামলা চালায় বিএসএফ। বিডিআর ক্যাম্পসহ আশপাশের গ্রাম দখলে নিতে এ বর্বরোচিত আক্রমণ চালায় তারা। ভোর সাড়ে ৪টার দিকে পূর্বদিক থেকে বিএসএফ যখন বিডিআর ক্যাম্পে গুলিবর্ষণ যখন শুরু করে তখন প্রথম ১০ মিনিট বিডিআর ছিল নিশ্চুপ। 

ভারতীয় বাহিনী এ ঘটনায় মনে করেছিল বিডিআর ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়েছে। এরপর তাদের একটি বাহিনী পশ্চিম গ্রামের দিক থেকে একটি দল ক্যাম্পের দিকে অসতর্কভাবে এগুতে শুরু করলে বিডিআর এর চারটি মেশিনগান একযোগে গুলিবর্ষণ শুরু করে। সকাল দশটা পর্যন্ত তুমুল যুদ্ধ চলে বিডিআর আর বিএসএফ এর মধ্যে। বিএসএফ প্রায় সকাল ১০টা পর্যন্ত বিওপি'র দু'শ গজ দূরে বাংলাদেশের সীমানায় ছিল। জামালপুর থেকে ৩৩ রাইফেল ব্যাটেলিয়ান-এর কমান্ডিং অফিসার লেঃ কর্নেল এস জামান-এর নেতৃত্বে অতিরিক্ত বিডিআর বড়াইবাড়ীতে পৌঁছার পর ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশের সীমানা ছেড়ে ওপারে পালিয়ে যায়। এরপর লাগাতার প্রায় দু'দিন চলে উভয়পক্ষের মধ্যে গুলিবিনিময়।

এ যুদ্ধে বিডিআর এর সাথে সাধারণ গ্রামবাসীও অংশ নেয়। যুদ্ধ শেষে ৩ জন বিডিআর জোয়ান ও ১৬ জন বিএসএফ সদস্য (বিএসএফ এর ভাষ্যমতে ১৯ জন) নিহত হয়। যুদ্ধে পরাজয় নিশ্চিত দেখে অনেক সঙ্গীদের লাশ ফেলেই বিএসএফ পালিয়ে যায় নিজেদের দেশে। এই যুদ্ধের ডামাডোলের মাঝেই বিএসএফ বড়াইবাড়ি ছিটমহলের ১৭৯টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে।

এই ভয়ানক যুদ্ধের ফলে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের অবনতি হবার আশঙ্কা তীব্র হয়ে উঠলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২২ এপ্রিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর সাথে এক টেলিফোন সংলাপে বসেন এবং এই সময়ে শেখ হাসিনা ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিডিআরের ভূমিকার জন্যে দুঃখ প্রকাশ করেন। অর্থাৎ বিডিআর এর এইরকম প্রতিরোধ গড়ে তোলা যে অনুচিত ছিল, সেটাই তিনি জানান দিয়েছিলেন বাজপেয়ীকে। এর পেছনে সুস্পষ্ট রাজনৈতিক ও নির্বাচনী উদ্দেশ্য হাসিলের পরিকল্পনা ছিল বলেই মনে করা হয়।

সেদিনের সেই ভয়াল যুদ্ধের পর থেকে বড়াইবাড়ি সীমান্তের মানুষ ১৮ এপ্রিলকে ‘বড়াইবাড়ি যুদ্ধ দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে। প্রতি বছর ১৮ এপ্রিল তারা নানাভাবে দিনটি স্মরণ করে। আত্মত্যাগী তিন বিডিআর জাওয়ানের জন্যে স্মৃতিসৌধও তারা নির্মাণ করেছে। গ্রামবাসীর কাছে এই যুদ্ধ এখনো পরিচিত মুক্তিযুদ্ধ নামেই। নিহত বিডিআর জওয়ানদের তারা শহীদ হিসেবেই স্মরণ করে।

এই ছিল মুক্তিযুদ্ধের পরের আরেক মুক্তিযুদ্ধের গল্প। আমি প্রায় নিশ্চিত করে বলতে পারি আমাদের নতুন প্রজন্ম, বিশেষ করে যারা শাহবাগে গিয়ে ‘রাজাকার **CK ইউ’ লিখে স্লোগান দেয়, তারা এই দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের কথা জানেনা। জানেনা তাদের প্রিয় দেশটার বুকে হানাদার কেবল পাকিস্তানি সৈন্যই ছিলনা, ছিল পাশের দেশের দাদারাও।

আজ যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বেচে খায়, তাদের মুখে কোনদিন দ্বিতীয় সেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার গল্প শুনিনা, কোন নতুন প্রজন্মের তরুণ কোন গোঁফঅলা বুদ্ধিপরজীবীর কাছে গিয়ে রৌমারি যুদ্ধের গল্প শুনতে চায়না। জানতে চায়না স্বাধীনতা আসলে কাকে বলে? বন্ধু রাষ্ট্র কাকে বলে? আমার দেশের ভূমি কেউ দখল করতে এলে তার প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হওয়া চাই?

নাহ। কেউ এইসব প্রশ্ন করতে চায়না। করতে পারেনা। কারণ চেতনার বড়ির ম্যানুফ্যাকচারিং ডেট হল ১৯৭১ এ। এরপর থেকে আর চেতনার বড়ির প্রোডাকশন হয়নি। হবেনা। কারণ এরপরের প্রোডাকশনে কোন বিজনেস নেই। প্রফিট নেই। যা আছে, তা হল গোলামি, চাটুকারি, চেতনার নামে মিথ্যের ফুলঝুড়ি আর জনগণের ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল। আছে ‘তারা আমাদের সাহায্য না করলে স্বাধীন হতে পারতাম না’ নামক চেতনার ইমিউনিটি ইনজেকশান। যেই ইনজেকশান আমাদের ৭১, পাকিস্তান আর রাজাকার ব্যাতীত অন্য সকল চেতনা থেকে ইমিউন করে দিয়েছে। দিয়েছে অন্ধ দাসত্বের লাইসেন্স।

যারা আজ প্রতিনিয়ত এদেশে পাকিস্তানের তোষামোদ করা রাজাকারদের নিয়ে দুশ্চিন্তায় কপালে ভাঁজ ফেলে দেয়, তাদের কপালের ভাঁজটি কোনদিন আজকের প্রধানমন্ত্রীর ভারতের ‘রাজাকারি’র কারণে পড়েনা। রাজাকারির সংজ্ঞা শুধু জামাতি আর দাড়ি টুপির হুজুরদের মাঝেই সীমাবদ্ধ। কেতাদুরস্ত পোষাকের কোন ধর্মহীনদের জন্যে অন্য দেশের রাজাকারি হারাম। তারা রাজাকারি করতেই পারেনা। ভারতের কথা বলছ? ওহে মর্কট সে তো বন্ধুত্ব! পার্থক্য বুঝতে হবে, বুঝলে?

তাই তো ভারত আমাদের দেশের মাটি দখল করতে চাইলেও কোন শাহবাগ বসেনা। কোন জাগরণ মিছিল নামেনা। কোন গণমঞ্চের শ্লোগান শুনিনা যে এ দেশের ভারতের রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধী বিএসএফ সদস্যদের ফাঁসি চাই। কোন চেতনার ফেরিওয়ালার সংগঠনকে বলতে শুনিনা ‘রৌমারি যুদ্ধের’ অপশক্তি হিসেবে ভারত সরকারকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে। চেতনায় টাল হয়ে থাকা কোন ‘তরুণ প্রজন্ম’-এর দ্বিতীয় মুক্তিযোদ্ধাদের দেখিনা ভারতীয় দূতাবাস ঘেরাও করতে, জুতা নিক্ষেপ করতে। কোন নিও-বঙ্গবন্ধু আওয়াজ তোলেন না ভারতের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবিতে।

অনেকেরই বিশ্লেষণ, আমাদের জাতীয় জীবনের অন্যতম কালো অধ্যায়, পিলখানা হত্যাকান্ড আর রৌমারি যুদ্ধের রয়েছে অটুট ঘটনাক্রমিক বন্ধন। সত্য কি তা আমরা জানিনা। তবে না জানা যতটা অপরাধ, জানার চেষ্টা না করা তার চাইতে বড় অপরাধ। আমরা সকলেই এই বড় অপরাধের বড় অপরাধী। আজ ভারতের আর প্রকাশ্যে আমাদের মাতৃভূমি দখল করতে আসতে হয়না, দেশের নানা রকম সম্পদ আমরা আজ ‘বন্ধুত্বের খাতির’ আর ‘৭১ এর কৃতজ্ঞতা’র প্যাকেটে মুড়ে গিফট করে চলেছি তাদের। আর এরই সাথে মিডিয়া, ফেসবুক, মাঠ ময়দান মঞ্চ গরম করছি স্বাধীনতার চেতনার গীত গেয়ে।

তবে আমার এত কথা সবই বৃথা। কারণ এখনো আমি তাদের নজরে পাকি রাজাকার। পাকি বীর্যে সৃষ্ট। ভারতের ‘আদরের’ আড়ালে ‘ধর্ষণের’ বিরুদ্ধে কন্ঠ যে-ই তুলবে, যে-ই অন্ধ জাতিয়তাবাদের অসারতার কথা বলবে, যে-ই দেশের সত্যিকার স্বাধীনতার কথা বলবে, সে-ই রাজাকার। এটাই হল নতুন দিনের দেশপ্রেমের সিলেবাসের দীক্ষা। এ সিলেবাসে শুধু আছে মূর্খ জাতিয়তাবাদ, পাকিস্তানীদের অন্ধ ঘৃণা, ইসলামকে জাতীয় জীবনে গৌন বিষয় হিসেবে দর্শন আর অটুট ভারতপ্রেম। এই চার জঘন্য শিক্ষার মেলবন্ধনই হল চেতনা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। এই কারণেই আমি সানন্দে এই চেতনা ঠ্যাং এ মাড়াই।

তবে তোমাদের সাথে আমি একমত। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়নি।

No comments:

Post a Comment