
সারা দেশ থেকে সেনাবাহিনী, বিজিবি, র্যাব ও পুলিশের গোয়েন্দা সদস্যদের পাঠানো রিপোর্টের ভিত্তিতেই এ সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করা হবে। আগামী দু-একদিনের মধ্যেই দেশের প্রায় সব জেলা থেকেই গোয়েন্দাদের রিপোর্ট পাঠানো শেষ হবে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, গত সপ্তাহ থেকেই সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগ মাঠে নেমে পড়েছে। অসামরিক গোয়েন্দাদের দেয়া তথ্যে পুরোপুরি ভরসা না রেখে বিভিন্ন জায়গায় বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের নামের তালিকা তৈরি করছে তারা।
এরইমধ্যে কক্সবাজার, সাতক্ষীরা, নোয়াখালী, নীলফামারী, জয়পুরহাট এবং বগুড়া জেলার গোয়েন্দা বাহিনী সরকারের কাছে রিপোর্ট পাঠিয়েছে বলে সূত্র জানায়।
গোয়েন্দা রিপোর্টে বিশেষ করে জামায়াত ও শিবির অধ্যূষিত এলাকাগুলোতে জামায়াতের বেশিরভাগ নেতাকর্মীর নামের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। জামায়াত-শিবিবের কর্মসূচিতে কোন কোন এলাকায় কারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের পূর্নাঙ্গ বায়োডাটাও উল্লেখ করা হয়েছে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে।
আর প্রত্যেক এলাকা থেকে গোয়েন্দাদের প্রতিবেদন তৈরিতে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগীতা করছে সরকার দল আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গসংগঠনগুলো।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, মাস দুয়েক আগে গোয়েন্দাদের পাঠানো প্রাথমিক প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সরকার প্রথম পর্যায়ে সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে বিরোধীদের দমন করতে অ্যাকশনে যাওয়ার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেয়।
সরকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেয়, যেখানেই বিএনপি ও জামায়াত-শিবিবের আন্দোলনের কারণে জননিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে সেখানেই পুলিশসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
বিশেষ করে ২৫ অক্টোবরের পর থেকে ঢাকায় কোনো ধরনের আন্দোলন যেন জামায়াত-বিএনপি জমাতে না পারে সেজন্য পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোর ভূমিকা পালনের নির্দেশ দিয়েছে সরকার।
রাজধানীর ন্যায় সারা দেশেও সরকারের ভূমিকা একই। পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও অন্যান্য প্রশাসনযন্ত্রের ওপর কোনো আঘাত এলে পাল্টা আঘাত করার নির্দেশ দেয়া হয়।
আন্দোলনকারীরা পুলিশের সঙ্গে অ্যাকশনে আসলেই পুলিশ গুলি ছুড়তে দ্বিধা করবে না বলেও সরকারের একাধিক মন্ত্রী হুশিয়ারি দিয়েছেন।
এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এককভাবে নির্বাচিত হওয়ার জন্য ইতোমধ্যে বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের কোনো দলকে তথাকথিত নির্বাচনকালীন সরকারে রাখেনি।
বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন প্রধান বিরোধী জোটের আন্দোলনকে প্রতিহত করার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে চূড়ান্ত অ্যাকশনে যাওয়ার ব্যাপারে একমাস আগেই সবুজ সংকেত দিয়েছে সরকার।
ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন জেলা ও বিভাগীয় শহরে বিরোধী দলের আন্দোলন দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অ্যাককশনে যায়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয় সূত্রে জানা গেছে, বিরোধী জোট বিশেষ করে জামায়াত মাঠের রাজনীতিতে সরব ভূমিকা পালন করায় দেশের কমপক্ষে ২০টি জেলায় সর্বাত্মক হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। এতে সরকারের ভাবমর্যাদা চরমভাবে ক্ষুণ্ন হচ্ছে বলে মনে করছে সরকার।
তাই প্রধান বিরোধী জোট এবং বিশেষ করে জোটের অন্যতম শরিক জামায়াত ও এর ছাত্রসংগঠন শিবিরের কর্মকৌশল সনাক্তকরণ এবং তাদের কঠোর হস্তে দমন করতেই সারাদেশে এই সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করতে যাচ্ছে সরকার।
এরইমধ্যে গোয়েন্দাদের পাঠানো বার্তায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয় দেশের জামায়াত ও শিবির অধ্যূষিত কমপক্ষে ২০টি জেলাকে চরম ঝুঁকিপূর্ণ জেলা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এসব জেলায় যেকোনো মূল্যে নির্বাচন প্রতিহত ও জামায়াতের আন্দোলনকে প্রতিহত করার জন্য র্যা ব, পুলিশ ও বিজিবির সমন্বয়ে গঠিত যৌথবাহিনী সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এরইমধ্যে লক্ষীপুর, সাতক্ষীরা, নীলফামারী, লালমনিরহাট, জয়পুরহাট, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীসহ বেশ কয়েকটি জেলা ও বিভাগীয় শহরে অভিযান শুরু করেছে যৌথবাহিনী।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয় থেকে যৌথবাহিনীকে অভিযানকালে আন্দোলনকারীদের দেখা মাত্র গুলি করারও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একারণে যৌথবাহিনী পরিচালিত অভিযানে এসব জেলায় কমপক্ষে জামায়াত-শিবিরের অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন। যৌথবাহিনীর অভিযানকালে আরও অন্তত শতাধিক নেতাকর্মী গুম হয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
নির্বাচনের ঠিক আগ মূহুর্তে সরকার এখন সারা দেশে সাঁড়াশি অভিযানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এজন্য সারা দেশে গোয়েন্দা বাহিনীকে তথ্যবহুল প্রতিবেদন জমা দিতে বলেছে সরকার। দু-একদিনের মধ্যে গোয়েন্দাদের পাঠানো এসব প্রতিবেদন হাতে পেতে যাচ্ছে সরকার।
গোয়েন্দা বিভাগ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের একধিক সূত্রে জানা গেছে, গোয়েন্দাদের পাঠানো রিপোর্টের পরেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের নেতৃত্বে ২৬ ডিসেম্বর থেকে সারাদেশে বিএনপি জামায়াত নিধনে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালিত হবে।
গত শুক্রবার নির্বাচন কমিশনের বৈঠকে আগামী ২৬ ডিসেম্বর সেনা মোতায়েনরে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তবে সূত্র জানায়, নির্বাচনকালীন সময়ে সেনাবহিনী মাঠে থাকলেও প্রকৃতপক্ষে নির্বাচন তদারকি করবে পুলিশ, বিজিবি ও র্যাব।
গত ১৯ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই সেল গঠন করেছে।
সূত্র জানায়, এই সেলের কাজ হবে জামায়াত-বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলের হরতাল ও অবরোধকে অযৌক্তিক ঘোষণা করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, জামায়াত-বিএনপি আন্দোলনের নামে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড চালানোর পরিকল্পনা করলে তাদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষনিক ব্যবস্থা নিতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা সমন্বয় সেল গঠন করা হয়েছে।
এজন্য সমন্বয় সেলের ফোন ও ফ্যাক্সের মাধ্যমে তথ্য জানাতে অনুরোধ করা হয়েছে।
এক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয় এমনকি যৌথবাহিনী আন্দোলনকারী জামায়াত-শিবির ও বিএনপি নেতাকর্মীদের নাম ঠিকানা ও কর্মকৌশল সম্পর্কে তথ্য নিতে সরকারী দল আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠন বিশেষ করে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কাছ থেকে তথ্য নিচ্ছে। তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে এরইমধ্যে যৌথবাহিনী বেশ কয়েকটি জেলায় অভিযান শুরু করেছে।
অপরদিকে রাজধানী ঢাকায় বিএনপিকে অনেকটা কোনঠাসা করে রেখেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তারা বিএনপি-জামায়াতের কোনো কর্মসূচি পালন করতে দিচ্ছে না। দলীয় কার্যালয়গুলো কার্যত বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
কিন্তু শিবিরের কর্মসূচি কোনোভাবে বন্ধ না করতে পেরে বেশ কয়েকজন নেতাকর্মীকে সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে ছবিসহ পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। কেউ তাদেরকে ধরিয়ে দিলে এক লাখ টাকা পুরস্কারেরও ঘোষণা করা হয়েছে।
পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানায়, সামনে সাঁড়াশি অভিযানের লক্ষ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় র্যাব-পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ছুটি বাতিল করে মাঠে থেকে দায়িত্ব পালন করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
একইসঙ্গে রাজধানীসহ সারা দেশের মাদ্রাসা, মসজিদ, কমিউনিটি সেন্টার গুলোতে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে বিশেষ নজরদারির নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
শীতাকালীন মহড়া শেষে আগামী ২৬ তারিখ থেকে ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত সেনাবাহিনীকে মাঠে থাকার নির্দেশ দিয়েছে কমিশন। পরিস্থিতি বুঝে তা বাড়ানো হতে পারে। তবে সিইসি সেনাবাহিনীর কাজের পরিধি কি ধরণের হবে তা উল্লেখ করেনি।
সিইসি জানিয়েছে, নির্বাচনকালীন দায়িত্ব হিসেবে প্রতি জেলায় এক ব্যাটালিয়ান সেনা সদস্য স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসাবে কাজ করবে।
সেনাবাহিনীর বাইরে বিজিবি, কোস্ট গার্ড, র্যাব, আর্মড পুলিশও থাকছে। ব্যাটলিয়ন আনসার সহযোগী ফোর্স হিসেবে পুলিশের সঙ্গে কাজ করবে।
এই সুযোগটিই নিতে যাচ্ছে সরকার। এ সুযোগে সরকার সেনাবাহিনীর পাশাপাশি যৌথ বাহিনীকে মাঠে রেখে সারাদেশে সাঁড়াশি অভিযানের ছক কষেছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের তথ্যানুযায়ী, নির্বাচন নির্বিঘ্ন করতে গোয়েন্দা রিপোর্টে তালিকাভুক্ত বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের দমনে ব্যবহার করা হবে যৌথ বহিনীকে। সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় দমন–পীড়নে কাজ করবে যৌথবাহিনী।
নির্বাচন ঠেকাতে মরিয়া বিএনপি-জামায়াত কোনোভাবেই ছাড় না দিলে গণহত্যার মতো ঘটনা ঘটার আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে।
পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক জানান, রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে সারাদেশে জনমনে যারাই আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা করবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। কোনোভাবেই দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে দেয়া হবে না।
সরকারের কাছে গোয়েন্দাদের প্রতিবেদন জমার কথা স্বীকার করে র্যাবের মহাপরিচালক (ডিজি) মোখলেছুর রহমান বলেন, আসন্ন নির্বাচন নিষ্কণ্টক রাখতে সরকার বদ্ধ পরিকর। সেক্ষেত্রে সরকার আমাদের যে নির্দেশনা দেবে শৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে আমাদের তাই করতে হবে।
গোয়েন্দাদের তথ্যের ভিত্তিতে সামনে রাজনৈতিক সংঘাতের আশঙ্কা করা হচ্ছে। সম্ভাব্য সহিংসতা এড়াতে র্যাবের পক্ষ থেকে কঠোরভাবে তা দমন করা হবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
এব্যাপারে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, সারাদেশে সেনাবাহিনীর সঙ্গে যৌথবাহিনীর সাঁড়াশি অভিযান পরিচালিত হতে পারে এমন নির্দেশনা আমরা এখনো পাইনি।
তবে যেখানে বেশি আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কা রয়েছে, সেখানেই অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। যদি আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয় এবং সরকার আমাদের সাঁড়াশি অভিযানে নামতে নির্দেশ দেয়, সেক্ষেত্রে অভিযান হতে পারে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
বিরোধী দলের আন্দোলন দমন করা বিজিবির কাজ নয় উল্লেখ তিনি আরও বলেন, বিশৃঙ্খলাকারী ও নাশকতাকারীরা যে দলেরই হোক না কেন, যথাযথ প্রক্রিয়ায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
এব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হাসান মাহমুদ খন্দকার জানিয়েছেন, যারাই নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি করবে, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এরইমধ্যে ফৌজদারি অপরাধের ঘটনায় জড়িত অনেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে। তবে সাঁড়াশি অভিযান সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।
No comments:
Post a Comment